পিগমি মানুষ । পৃথিবীর সবচেয়ে খর্বকায় আদিম মানব উপজাতির রহস্য
প্রানি কুলের বৈচিত্রওময়তার কারণে আফ্রিকার জঙ্গল এমনি তেই বেশ রোমাঞ্চকর। হিংস্র চতুষ্পদ থেকে শুরু করে বিষাক্ত সরীসৃপ আফ্রিকার জঙ্গল গুলোকে একি সাথে করে তুলেছে ভয়ংকর । আর রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে খর্বকায় এক মানব সম্প্রদায় নিজেদের অস্বাভাবিক খর্ব আকৃতির জন্য যারা পৃথিবীর মানুষের কাছে পিগমি নামে পরিচিত। এই পিগমি কথা টি এসেছে গ্রীক ভাষা থেকে যার অর্থ কনুই পর্যন্ত । তবে খুদ্র কোন কিছু বোঝাতে পিগমি শব্দটি ব্যাবহার করা হয়। প্রকৃত পক্ষে এই আদিবাসি রা স্বাভাবিক এর তুলনায় বেশ ছোট আকৃতির হয়ে থাকে বলেই এমন নামকরন। পিগমি কিন্তু কোন গোত্রের নাম নয় এই এটি কয়েকটি গোত্রের সমষ্টি নাম। বাঁকা,বুটি,নেপ্রিত সহ কয়েকটি গোত্রের আদিবাসীদের সমষ্টি নাম পিগমি বা খর্বকায় মানুষ। এদের মূল বাসস্থান ঘন জঙ্গল। ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে এদের বর্বর ,ভয়ঙ্কর, অসভ্য ,বনমানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও এরা কিন্তু বেশ শান্তিপ্রিয় জাতি ।
পিগমি দের বাহ্যিক রুপ
প্রাপ্ত বয়স্ক পিগমি আদিবাসিদের গড় উচ্চতা ৪ ফুট হয়। ১২ থেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত এদের স্বাভাবিক দৈহিক বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। ১৪ বছর বয়সের পরে এদের আর বৃদ্ধি ঘটে না ফলে একজন ৪০ বছররের প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ এবং ১৪ বছরের কিশোর কে দেখতে একিরকম লাগে।
পিগমি রা শুরু থেকেই জঙ্গলের গভীরে বাস করে আসছে। ফলে জঙ্গলের পরিবেশে মানিয়ে নিতে কালের বিবর্তনে তাদের আকৃতি ছোট হয়ে গেছে, কেননা খর্বাকৃতি মানুষের জঙ্গলের পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ । এই পিগমি রা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তবে এদের বেশির ভাগ বাস করে আফ্রিকার ঘন জঙ্গলে। আফ্রিকার কঙ্গো ও ক্যামেরুন এর জঙ্গলে বাস করে অধিকাংশ পিগমি উপজাতির মানুষ।
প্রায় ৩০থেকে ৪০ হাজার গোত্রের পিগমি মানুষ বাস করে ক্যামেরুন জঙ্গলে । তবে আফ্রিকার বাইরে ও এদের বসবাস রয়েছে ।দক্ষিণ এশিয়া,অস্ট্রেলিয়ার মাটি তে ও এদের দেখতে পাওয়া যায়। মালয়েশিয়া ,পাপুয়ানিউগিনি,আন্দামান নিকবর এ ও দেখতে পাওয়া যায় খর্বাকৃতি এই সব মানুষের । আগেই বলেছি পৃথিবীর আদিমতম জনগোষ্ঠী হল পিগমি রা ।নব্যপ্রস্থের যুগ থেকেই এদের সন্ধান পাওয়া যায় ।
পিগমি রা প্রায় ৩০ হাজার বছরের পুরনো জনগোষ্ঠী । একেবারে শুরু থেকেই এদের আবাস্থল হল গভির বন জঙ্গল ।বনই এদের আবাস আবার বনই এদের জীবিকা । তাই যে কোন ভাবেই এরা সবুজ বনাঞ্চল সংরক্ষণ করতে চায় পিগমিরা ।কিন্তু বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণে পিগমি দের অস্তিত্ব আজ সংকটের মুখে ।
পিগমিদের শিকার
পিগমিদের জীবন বেশ সরল । বনজঙ্গলের বাইরের মানুষের মত জটিলতা কুটিলতা তাদের মধ্যে নেই। এরা বনে বসবাস কারি এক শান্তিকারি মানব সম্প্রদায়।বলা যায় জাতি হিসেবে পিগমিরা যাযাবর। বনে জঙ্গলে দল বেঁধে ঘুরে বেরায় ,সুবিধা মত স্থানে পাতা ও মাটি দিয়ে অস্থায়ী বাসস্থান তৈরি করে।
কিছুদিন পরে আবার হারিয়ে যায় বনের অন্য কোন স্থানে । তবে তাদের মধ্যে কঠোর সামাজিক প্রথার দেখা পাওয়া যায় । প্রতিটি দলে থাকে একজন করে দলপতি যার নির্দেশ মেনে চলে পুরো দল। বিচরণ, শিকার, প্রার্থনা সব কিছু চলে তার নির্দেশে।
শিকার পিগমিদের খাদ্য সংগ্রহের মূল উপায় এছাড়াও বনের ফল ও মধু তারা খাদ্য হিসেবে ব্যাবহার করে। এছাড়া পিগমি রমনিরা মাছ শিকার করে থাকে। বনের বিভিন্ন চতুষ্পদ জন্তু তারা খাদ্য হিসেবে গ্রহন করে। এই খাদ্য সংগ্রহের জন্য তারা দল বেঁধে শিকারে যায়।
নারি ও পুরুষ উভয়ে শিকারে অংশ নেয় এমন কি শিকারে তারা এতই দক্ষ যে দূর থেকে শিকারের গন্ধ টের পায় তারা । আর বনের ভেতর প্রানির পায়ের ছাপ দেখে তারা বলে দিতে পারে এটা কোন প্রানি এবং তার বয়স কত। শিকারে জাওয়ার আগে দলের প্রধান শিকারি দের জন্য মন্ত্র পাঠ করে তাদের বিপদ ও অমঙ্গলের হাত থেকে রক্ষার জন্য দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করে।
পিগমিদের সংস্কৃতি
সফল শিকারের পর শুরু হয় উৎসব। পিগমিদের সংস্কৃতির একটা বড় অংশ হল সঙ্গীত তারা নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ ও দেবদেবীর আরাধনায় সঙ্গীত ও সুরের সাধনা করে থাকে। ছোট বেলায় পিগমি শিশুদের পরিবার থেকে শিকারের পাশাপাশি সঙ্গীত ও সুরের শিক্ষা দেওয়া হয়।
শিকারের আগে ও পরে সঙ্গীত ও নৃত্য পিগমি দের সংস্কৃতির অংশ। ঢোল তাল জাতীয় বাদ্য যন্ত্রের সমন্যয়ে আয়োজিত এই সব অনুষ্ঠানে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই অংশগ্রহন করে।
তবে পিগমি রা বেশ কুসংস্কার আচ্ছন্ন জাতি এই কুসংস্কার এদের এগিএয়া যাওয়ার পথে বাধা । এ ছাড়া পিগমি রা আধ্যাত্মিকবাদে বিশ্বাস করে । তা ছাড়া তাদের প্রতিটি দলে ওঝা নামক একজন করে আধ্যাত্মিক গুরু থাকেন যিনি তাদের দেবতাদের তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে নানা ক্রিয়া করে থাকেন ।
পিগমি দের বেশ কিছু দেব দেবী রয়েছে যাদের মধ্যে বেশিরভাগ বন দেবতা। বন দেবতাদের মধ্যে তারা যার পুজা করে তার নাম মুকুন্দি। পিগমিদের সবচেয়ে শক্তিশালী দেবতা হল মুকুন্দি। পিগমি নামটি বাইরের সভ্য সমাজের মানুষের দেওয়া ।নিজেদের মধ্যে তারা “বা” নামে পরিচিত যার অর্থ মানুষ।
যেহেতু পিগমি কোন একক গোষ্ঠী নয় অর্থাৎ বিভিন্ন গোত্রের খর্বকায় মানুষদেরই পিগমি বলা হয় তাই এদের কোন নির্দিষ্ট ভাষা নেই। পিগমি রা নিজ নিজ ভাষায় কথা বলে।যদিও অনেক সময় এই সব গোত্রের ভাষা কাছাকাছি ধরনের হয়।
তবু এদের নির্দিষ্ট কোন ভাষা নেই ।যেমন বাঁকা গোত্রের পিগমি রা বাঁকা ভাষায় কথা বলে। তবে যে ভাষাতেই কথা বলুক পিগমিরা খুব কম কথা বলে প্রয়োজন ছাড়া এক গোত্রের মানুষ অন্য গোত্রের মানুষের সাথে কথা বলে না।
পিগমি গোত্র – বাঁকা গোত্র – কঙ্গো এবং ক্যামেরুন এর নাতিশীতোষ্ণ জঙ্গলে এদের বাস এছাড়া নদির তীরে ও এদের বাসস্থান থাকে। উচ্চতায় এরা ১২০ থেকে ১৪০ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। গানবাজনা এদের খুব পছন্দের বিনোদন । এদের আধ্যাত্মিক বন দেবতার নাম বন দেবতা “জেঙ্গি” সর্বপ্রধান ইশ্বর কে এরা কম্বা নামে ডেকে থাকে।
বুটি গোত্র – বুটি গোত্রের পিগমি বাস করে কঙ্গোর উত্তরপূর্ব অঞ্চলে ইতুরি নামে এক বনে । ধারনা করা হয়ে থাকে বিগত ২০০০ বছর ধরে তারা এই অঞ্চলে বাস করছে।যেকোন মূল্যে বিবাদ কলহ থেকে দূরে থাকার ছেস্তা করে।
যদি কোন কারণে বিবাদে জড়িয়ে পরে তবে এরা তার সমাধান করে হাঁসির মাধ্যমে ।এরা বেশ সংঘবদ্ধ জীবনযাপন করে । এদের মধ্যে কোন লিঙ্গ ভেদ নেই।
নিগ্রিদ গোত্র- নিগ্রিদগোত্রের পিগমি রা দক্ষিন এশিয়াতে বসবাস করে । মালয়েশিয়া ,ফিলিপাইনদ্বিপ্পুঞ্জ,আন্দামান নিকবর দ্বিপ্পুঞ্জএর বিভিন্ন জঙ্গলে এদের বাস। অন্যান্য গোত্রের তুলনায় নিগ্রিদরা সংখ্যায় অনেক কম। তা প্রায় ১৫ হাজারের বেশি হবে না। এরা ফিলিপাইনের জাতীয় ভাষায় কথা বলে। এরা ও আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস করে । তবে সম্প্রতি অনেকে খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন ।
তাদের ইতিকথা
পিগমিরা পৃথিবীর আদিমতম মানবজাতি হওয়া সত্ত্বেও ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে তাদের ওপর চলেছে অকথ্য নির্যাতন, নিজেদের শারীরিক আকৃতি ও গায়ের রঙের জন্য অসংখ্যবার তারা শিকার হয়েছে বর্ণবাদের। ১৯০০ সালে বেলজিয়ামে পিগমিদের ধরে নিয়ে গিয়ে প্রদর্শনীতে দেওয়া হতো । প্রওআণ্ডা গণহত্যার সময় প্রায় একতৃতীয়াংশ পিগমি মানুষ হত্যা করা হয়।
এছাড়া কঙ্গোর সেনারা অকথ্য অত্যাচার করে তাদের ওপর এমনকি তাদের হত্যা করে মাংস আহার করার মত জঘন্য ঘটনা ও ঘটেছে পিগমিদের সাথে।এবং পিগমি নারিদের যৌন দাসী হিসেবে ব্যাবহারের মত ঘৃণ্য কাজ ও হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।বরাবরই শান্তী প্রিয় জাতি জঙ্গলের সবুজের মধ্যে তারা শান্তি খুঁজে পায়।
কিন্তু জঙ্গলের বাইরের তথাকথিত সভ্য মানব সমাজ আজ পৃথিবীর প্রাচীনতম মানব অস্তিত্তের সংকটের মূল কারন। ইতালি, জাপান ও পর্তুগালের মত দেশ গুলোতে কাঠের বিভিন্ন শিল্পের জন্য নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে ।যা পিগমিদের অস্তিত্ব কে সংকটের মুখে দাঁড় করিয়েছে। বাইরের জগতের সাথে পিগমিরা পেরে উঠবে না তাই মুখবুজে যাওয়া ছাড়া কিছু করার নেই তাদের। তাই পৃথিবীর আদিমতম মানব সম্প্রদায় আজ হারিয়ে যাচ্ছে ।
আরও পড়ুন – ভারতের ভাস্কর্যের অন্যতম আকর্ষণ জলকাণ্ডেশ্বরের প্রাচীন মন্দির
প্রতিবেদন – প্রভা গাঙ্গুলি
আমাদের ফেসবুক পেজ – https://www.facebook.com/somoyasomoy.co
Add Comment